আগামী ৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে পালিত হবে ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ-২০২৫’। ইলিশের উৎপাদন ও প্রাপ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছরই সরকার এই সপ্তাহ উদযাপন করে থাকে, যাতে জাটকা ধরা, পরিবহন, মজুদ ও বিক্রির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে— “জাটকা ধরা বন্ধ হলে, ইলিশ উঠবে জাল ভরে।”
এ উপলক্ষে ৭ এপ্রিল দুপুরে সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এসব তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ইলিশ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সেই লক্ষ্যে একটি কার্যকর ও বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবছরের জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদযাপিত হবে দেশের ইলিশসমৃদ্ধ ২০টি জেলায়, যেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে বরিশাল বিভাগের সদর উপজেলার বেলস পার্কে এর উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হবে। একই দিনে বরিশাল সদর উপজেলার ডিসি ঘাট সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতে অনুষ্ঠিত হবে এক বর্ণাঢ্য নৌ-র্যালি।
ফরিদা আখতার আরও বলেন, জাটকা হচ্ছে ১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের কম দৈর্ঘ্যের ইলিশ। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং দুই কেজির অধিক হলে তা ৬০ থেকে ৬২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। তাই ছোট আকারের এই জাটকাগুলোকে ধরা বন্ধ করা গেলে তা ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ ইলিশে পরিণত হয়ে বাজারে সরবরাহ বাড়াবে এবং ইলিশের দামও মানুষের আয়ত্তে থাকবে।
উল্লেখ্য, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার টন, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১১ শতাংশ এবং জাতীয় জিডিপির এক শতাংশেরও বেশি অবদান রাখছে। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে বাংলাদেশের নদ-নদী, মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চল থেকে, যার ফলে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন শীর্ষস্থানে রয়েছে। এই খাতে প্রায় ছয় লাখ মানুষ সরাসরি এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে নিয়োজিত আছেন, যারা ইলিশ পরিবহন, বিক্রি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে যুক্ত।
সরকার ইতোমধ্যে ইলিশ সংরক্ষণে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। ইলিশের প্রজনন সময় বিবেচনায় নিয়ে বছরে ২২ দিন মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের সবখানে জাটকা ধরা, পরিবহন, মজুদ এবং ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। দেশের ইলিশসমৃদ্ধ নদনদীতে ছয়টি অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে নির্ধারিত সময়ে সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকে। নিষিদ্ধ মৌসুমে জেলেদের জীবনধারণে সহযোগিতা হিসেবে সরকার ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ করছে। এছাড়া ২০১৯ সালে উপকূলীয় নিঝুম দ্বীপ ও তার সংলগ্ন ৩,১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় একটি সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে, যা ইলিশসহ অন্যান্য জলজ সম্পদ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বর্তমানে ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’ বাস্তবায়ন করছে, যার মাধ্যমে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা উন্নয়ন এবং সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ চালু রয়েছে, যার মাধ্যমে ইলিশ উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে। এছাড়া মৎস্য সংরক্ষণ আইন যুগোপযোগী করতে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ফরিদা আখতার বলেন, প্রতিবছর এই সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মৎস্য অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যাব ও নৌ-পুলিশের সমন্বয়ে আইন বাস্তবায়ন করা হয়। জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও অভিযানের মাধ্যমে নিষিদ্ধ সময়ে বাজার, আড়ত ও মাছঘাটে নজরদারি চালানো হচ্ছে। এসব কার্যক্রম যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে সারা বছর জুড়েই ইলিশের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি আরও জানান, সরকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে যাতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসীদের জন্য ১১ হাজার টন ইলিশ রপ্তানি করা যায়।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ অংশে তিনি দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানান যে, জাতীয় মাছ ইলিশের উন্নয়নে সকলে যেন জাটকা আহরণ, কেনাবেচা এবং ভোগ থেকে বিরত থাকেন। সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ সার্থক ও সফল হবে বলেই তার প্রত্যাশা।