বিশ্বের প্রায় সকল দেশে চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। নানান কারণে দেশের সব নাগরিক একইরকম সুযোগ-সুবিধা পান না, চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কিছুটা এগিয়ে নিতেই কোটা রাখা হয়। দেশের পক্ষে লড়াই করা নাগরিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্মান দেখিয়েও কোটা সুবিধা দেওয়া হয়। এছাড়া অনগ্রসর অঞ্চলের লোকজন, প্রতিবন্ধীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের মূলস্রোতে তুলে আনতে কোটা রাখা হয়। শুধু তা-ই নয়, দেশের বিরুদ্ধে কাজ করা লোকজনের নাগরিকত্ব বাতিল, তাদের পরিবারের সদস্যদের চাকরির ক্ষেত্রে কালো তালিকাভুক্তির ব্যবস্থাও রয়েছে বহু দেশে। জার্মানিতে আজও নাজি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়।
বাংলাদেশে কোটা প্রণয়ন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭২ সালে। কালক্রমে এতে অনেক সংস্কার আনা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটা ছাড়াও নারী, অনুন্নত জেলার অধিবাসী, আদিবাসী সম্প্রদায় এবং প্রতিবন্ধীদের জন্যও কোটা ছিল ২০১৮ সালের আগপর্যন্ত। তবে কখনই যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের কালো তালিকাভুক্ত করে চাকরি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। বরং ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যুদ্ধাপরাধীদের এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রের সকল স্তরে সুযোগ করে নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীরা সরকারও গঠন করেছে, রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী এবং অনেককে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হয়েছে, জাতির জনকের খুনিকে সংসদ সদস্য করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা কুলাঙ্গারদের পরিবারের সন্তানরা বীরদর্পে এদেশে টিকে রয়েছে। সরকারি চাকরিতে তো আছেই। এমন সুযোগ বিশ্বের কোনো দেশে দেশবিরোধীরা পায়নি, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে ব্যতিক্রম।
১৯৭১ সালে রণাঙ্গনের শহিদ এবং যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিলেন অস্বচ্ছল, অল্পশিক্ষিত ও অনগ্রসর পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। যুদ্ধের সময় এবং ৭৫ পরবর্তী সময়ে তাঁদের পরিবারের ওপর অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের তুলনায় বরং তাঁরা যোজন ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েন। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার আওতায় আসতে তাদের বহুকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত ৩০% কোটা মূলত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা সম্মানসূচ পদক্ষেপ। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারগুলো কখনই এটি ভালো চোখে দেখেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের লোকজন সরকারি চাকরিতে থাকলে এদেশকে আবারও পাকিস্থান বানানো যাবেনা, এমন একটা আক্ষেপ তাদের সবসময়। আর তাই এ নিয়ে সমাজে ছড়ানো হয়েছে গুজব। সেইসাথে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান ও অবজ্ঞাসূচক কথা বলা হয়েছে সবসময়। দাবি করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে অযোগ্য লোকজনকে নাকি নিয়োগ দেওয়া হয় সরকারি চাকরিতে। অথচ এটি সম্পূর্ণ অসত্য।
সর্বশেষ কোটা আন্দোলনের সময় কিছু ভয়াবহ অসত্য ও গুজব ছড়ানো হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে এবং রাজপথে। স্লোগান দেওয়া হয়েছে- মেধা নাকি কোটা? এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যারা চাকরি পান, তারা মেধাবী নন কিন্তু বিশেষ সুযোগ দিয়ে তাদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে মেধাবীদের বঞ্চিত করে। আবার বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায় সেই গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই বলে যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যাদের চাকরি দেওয়া হয়, তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব লোকজন। ব্যাপারটা কি সত্য? আসুন কিছু বিষয় জেনে নেওয়া যাক।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই কোটা সুবিধা পাওয়া যায়। ফলে যারা সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে যোগদান করেন, তারা প্রত্যেকেই মেধার প্রমাণ দিয়ে আসা যোগ্য ব্যক্তি। প্রবল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াদের মাঝে নম্বরের পার্থক্য অতি নগণ্য। চূড়ান্ত মেধা তালিকায় যারা আসেন, তাদের মধ্যে কোটাধারী হাতেগোণা মাত্র কয়েকজন। খুব অল্পই সুবিধা পান তারা। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% হলেও ৩৯ তম বিসিএস পর্যন্ত মাত্র একবার সর্বোচ্চ ৮.৫% কোটা পূরণ হয়েছে। অধিকাংশ সময় এটি ২-৩% এরচেয়ে বেশি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এতেই বোঝা যায়, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারগুলো কতটা পিছিয়ে আছে। ২-৩% এর পর সেই কোটার বাকি অংশটা অর্থাৎ ২৭-২৮% শূন্যস্থান পূরণ হয়েছে মেধা তালিকা থেকে ক্রম অনুসারে। ২০১৮ সালের বিসিএস পরীক্ষায় কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এরপর থেকে কি সর্বত্র মেধাবীদের জয়জয়কার দেখা গিয়েছিল? পরিসংখ্যান কী বলছে?
২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের পর মেধাবীর মেধার চিত্র-
► ৪০ তম বিসিএস পরীক্ষায় ৪ লাখ ১২ হাজার প্রার্থী আবেদন করেন। প্রিলি উত্তীর্ণ হন ২০ হাজার ২৭৭ জন। পাসের হার ৪.৯২%।
► ৪১ তম বিসিএস পরীক্ষায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থী আবেদন করেন। প্রিলি উত্তীর্ণ হন ২১ হাজার ৫৬ জন। পাসের হার ৪.৪৩%।
► ৪৩ তম বিসিএস পরীক্ষায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ প্রার্থী আবেদন করেন। প্রিলি উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৯ জন। পাসের হার ৩.৫%।
► ৪৪ তম বিসিএস পরীক্ষায় ২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৬০ প্রার্থী আবেদন করেন। প্রিলি উত্তীর্ণ হন ১১ হাজার ৭৩২ জন। পাসের হার ৪.২৪%।
► ৪৫ তম বিসিএস পরীক্ষায় ৩ লাখ ১৮ হাজার প্রার্থী আবেদন করেন। প্রিলি উত্তীর্ণ হন ১২ হাজার ৭৯২ জন। পাসের হার ৪.০২%।
► সর্বশেষ গত এপ্রিলে ৪৬ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন ২ লাখ ৫৪ হাজার। প্রিলি উত্তীর্ণ হন ১০ হাজার ৬৩৮। পাসের হার ৪.১৯%।
এই পরিসংখ্যানে স্পষ্টত বোঝা যায় প্রিলিমিনারিতে কৃতকার্য হওয়া কত কঠিন। এরপর আছে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা। ফলে এটা ধরেই নেওয়া যায়, সকল স্তর পার হয়ে নিয়োগ পাওয়া সব প্রার্থীই মেধাবী। মূলত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সামাজিকভাবে হেয় করতেই এই বিতর্কটা উস্কে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে, দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করানো যাবেনা, এটা সরকারবিরোধীরা ভালই জানে। সেজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত কোটা প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে দীর্ঘদিন ধরেই ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে একটা পক্ষ। যারা চায় না, এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কেউ সরকারি চাকরিতে উচ্চপদে আসীন থাকুক। তাহলে তাদের অপরাজনীতি ব্যাহত হবে।
কোটার বিরোধিতার করতে গিয়ে তারা বিদেশি গণমাধ্যমে আজগুবি অনেক তথ্য দিয়েছে। যার মধ্যে ছিল দেশে চাকরির বাজার অপ্রতুল, কর্মসংস্থানের সুযোগ কম, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ইত্যাদি। অথচ কোটার কারণে আন্দোলনরত মেধাবীরা চাকরির সুযোগ পাচ্ছেনা ইত্যাদি। যদিও প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। দেশে সরকারি-বেসরকারি খাতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বিগত কয়েক বছরে, যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। দেশে দক্ষ লোকবলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন জায়গায় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়াও হাজার হাজার কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যাতে রয়েছে কাজের সুযোগ। এছাড়া সরকারি অনেক দপ্তরেই সারাবছর লোক নিয়োগ হয়। তবে আক্ষেপের বিষয় হলো, যোগ্য লোকের অভাবে এবং পরীক্ষায় পাস না করায় বিগত কয়েক বছরে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাতিল হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সত্যিকারের মেধাবীরাই নিয়োগ পাচ্ছে এসব চাকরিতে, এরচেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
দি ইকোনমিক টাইমস ইন্ডিয়া (https://economictimes.indiatimes.com/news/international/world-news/why-are-bangladesh-students-protesting-against-job-quotas/articleshow/111831842.cms?) এবং ভয়েস অব আমেরিকায় (https://www.voanews.com/a/why-are-bangladesh-students-protesting-government-job-quotas-/7703253.html) প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, কোটায় সংরক্ষিত ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বরাতে এমন হাস্যকর দাবি করা হয়েছে। আসলে কি তাই?
যেখানে মেধা যাচাইয়ের সকল ধাপ অতিক্রম করে সর্বোচ্চ ২-৩% এর বেশি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়া অসম্ভব, সেখানে নিয়োগপ্রাপ্ত বাকি ৯৭-৯৮% কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধীপক্ষের লোকজন? তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা মানেই তো আওয়ামী লীগ করা লোকজন নয়। দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেক বিরোধী রাজনৈতিক দল রয়েছে। এসব দলেও বীর মুক্তিযোদ্ধারা উচ্চপদে আসীন। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতাদর্শ লালন করেন। নিয়মিত সরকারবিরোধী কর্মসূচিতেও অংশ নেন। এটাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও সন্তান রয়েছেন। যাদের অনেকেই বিভিন্ন সময় কোটার সুবিধা ভোগ করেছেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বরাতে সংবাদে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেই আলোকে বলা যায়, অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরাও যদি চাকরিতে নিয়োগ পায়, তাদেরকে শেখ হাসিনার নিজস্ব লোক দাবি করতে হবে। তর্কের খাতিরে একটা প্রশ্ন রাখাই যায়, কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি সরকারি দপ্তরে নিজস্ব লোকজন রাখতে চান, তবে কেন এত কাঠখড় পুড়িয়ে, এতগুলো মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষার মাধ্যমে রাখতে যাবেন? এরচেয়ে কি সহজপন্থা আর নেই?
বাস্তবতার নিরিখে তাই বলা যায়, দি ইকোনমিক টাইমস ইন্ডিয়া এবং ভয়েস অব আমেরিকার দাবিগুলো হাস্যকর এবং অবান্তর। এবং এসব আজগুবি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর দায়ে এসব সংবাদমাধ্যমকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিৎ।