ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর গাজা উপত্যকায় নতুন সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা, বিশেষ করে গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পরিকল্পনা, দেশটির সামরিক নেতৃত্ব, জিম্মিদের পরিবার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই পরিকল্পনা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর শুরু হওয়া প্রায় ২২ মাসের যুদ্ধকে আরও তীব্র করতে পারে, যা ইতিমধ্যে গাজায় ৬১,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু এবং লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটিয়েছে। বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পদক্ষেপ ইসরাইলকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করতে পারে এবং জিম্মিদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরাইলের নিরাপত্তা ক্যাবিনেট বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হামাসের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করা এবং জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করা। নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, ইসরাইল গাজা দখল বা সংযুক্ত করতে চায় না, বরং হামাস থেকে “গাজাকে মুক্ত” করতে এবং একটি শান্তিপূর্ণ বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে হবে না। তিনি ফক্স নিউজকে বলেছেন, “আমরা গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চাই, তবে এটি ধরে রাখতে চাই না। আমরা একটি নিরাপত্তা ঘের তৈরি করতে চাই এবং গাজাকে এমন আরব শক্তির হাতে তুলে দিতে চাই যারা এটিকে সঠিকভাবে শাসন করবে।”
ইসরাইলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির গাজার সম্পূর্ণ দখলের বিরোধিতা করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এই পদক্ষেপ ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে গাজায় আটকে ফেলতে পারে, যেখান থেকে তারা ২০০৫ সালে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, এবং জিম্মিদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। মঙ্গলবার একটি তিন ঘণ্টার উত্তপ্ত বৈঠকে জামির নেতানিয়াহুকে বলেছেন, সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে গাজার ৭৫% নিয়ন্ত্রণ করে, এবং পূর্ণ দখল জিম্মিদের মুক্তির জন্য কূটনৈতিক আলোচনার চেয়ে কম কার্যকর হতে পারে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ এক্স-এ বলেছেন, সামরিক প্রধানের মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে, তবে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সেনাবাহিনীর দায়িত্ব।
জিম্মিদের পরিবার এবং বিরোধী নেতা ইয়ার ল্যাপিডও এই পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ল্যাপিড এটিকে “বিপর্যয়” বলে অভিহিত করে বলেছেন, এটি জিম্মিদের মৃত্যু, সৈন্যদের হতাহত, এবং অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। জিম্মিদের পরিবারের প্রধান প্রচারণা গ্রুপ, হোস্টেজ অ্যান্ড মিসিং ফ্যামিলিজ ফোরাম, এই পরিকল্পনাকে জিম্মিদের “পরিত্যাগ” হিসেবে অভিহিত করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এটিকে “বিপজ্জনক উত্তেজনা” বলে অভিহিত করে সতর্ক করেছেন যে, এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য “বিপর্যয়কর পরিণতি” ডেকে আনতে পারে এবং জিম্মিদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক এই পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লেয়েন এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এই পরিকল্পনার পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। স্টারমার বলেছেন, এটি “ভুল” এবং “আরও রক্তপাত” ডেকে আনবে। জার্মানি, ইসরাইলের দীর্ঘদিনের মিত্র, গাজায় ব্যবহারযোগ্য সামরিক সরঞ্জামের রপ্তানি স্থগিত করেছে, চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ বলেছেন, এই পদক্ষেপ ইসরাইলের লক্ষ্য অর্জনকে আরও কঠিন করে তুলবে।
অন্যান্য দেশ, যেমন তুরস্ক, চীন, মিশর, জর্ডান, সৌদি আরব, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, এবং ডেনমার্কও এই পরিকল্পনার নিন্দা করেছে। তুরস্ক এটিকে “গণহত্যা ও দখলদারির ধারাবাহিকতা” হিসেবে অভিহিত করেছে, এবং সৌদি আরব এটিকে “বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি” বলে মনে করে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর এটিকে “পাগলামি, দায়িত্বজ্ঞানহীন, এবং বিপজ্জনক” বলে সমালোচনা করেছেন।
গাজায় মানবিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি মূল্যায়ন অনুযায়ী, গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর গাজায় কমপক্ষে ৯৯ জন অপুষ্টির কারণে মারা গেছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বুধবার একটি খাদ্যবাহী ট্রাকের উপর হামলায় ২০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের মতে, গাজায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০০ ট্রাক ত্রাণ প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমানে দিনে মাত্র ৭০-৮০ ট্রাক প্রবেশ করছে।
২০২৩ সালের হামাসের হামলায় ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৪৯ জন এখনও গাজায় রয়েছেন, এবং ইসরাইলের অনুমানে তাদের মধ্যে ২০ জন জীবিত আছেন। হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ সম্প্রতি দুজন অপুষ্ট জিম্মির ভিডিও প্রকাশ করেছে, যা আন্তর্জাতিক নিন্দার জন্ম দিয়েছে। হামাস সতর্ক করেছে, নতুন অভিযান জিম্মিদের জীবনকে বিপন্ন করতে পারে।
নেতানিয়াহু তার ডানপন্থী জোট সরকারের চাপের মুখে রয়েছেন, যারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং গাজায় ইহুদি বসতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে। তবে, ইসরাইলের জনগণের একটি বড় অংশ এবং জিম্মিদের পরিবার যুদ্ধবিরতি এবং কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ইসরাইলের প্রতি জনসমর্থন কমছে, গত মাসের একটি গ্যালাপ জরিপে মাত্র ৩২% আমেরিকান ইসরাইলের সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় ত্রাণ সীমিত করার জন্য ইসরাইলের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন, তবে সরাসরি এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেননি।
নেতানিয়াহুর গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে গভীর বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। এই পদক্ষেপ গাজার মানবিক সংকটকে আরও তীব্র করতে পারে, জিম্মিদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে, এবং ইসরাইলকে বিশ্ব মঞ্চে আরও বিচ্ছিন্ন করতে পারে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ শনিবার (৯ আগস্ট) এই বিষয়ে জরুরি বৈঠক করবে, যা এই সংকটের গুরুত্বকে তুলে ধরে।