জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাব এবং মানবসৃষ্ট সংকট ও অব্যবস্থাপনার দ্বিমুখী চাপে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় দ্বীপ ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরি-মুকরি আজ অস্তিত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ার এবং পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ায় এখানকার জনজীবন এমনিতেই বিপর্যস্ত। এর ওপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। চলতি নিম্নচাপের সময় দ্বীপের প্রধান স্লুইসগেটটির দরজা খোলা থাকায় দুর্যোগের ভয়াবহতা বেড়েছে বহুগুণ।
ভোলা জেলা সদর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটি নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। কিন্তু প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য এখন সংকটের মুখে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত কয়েক বছর ধরে জোয়ারের পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আগে যা বছরে দু-একবার ঘটত, এখন প্রায় প্রতিটি অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারেই লোকালয় প্লাবিত হচ্ছে।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন সংকট—পানির লবণাক্ততা। মিঠাপানির উৎসগুলো লবণাক্ত পানিতে ভরে যাওয়ায় একদিকে যেমন খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, তেমনি কৃষিকাজ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করেছে মৎস্য ও পশুসম্পদের ক্ষতি। জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে শত শত মাছের ঘের ও পুকুর, যা স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
শাহাবাজপুরের বাসিন্দা ও স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ী মো. শামিম তার ক্ষতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, “লবণ পানিতে আমাদের এলাকার পুকুরের মাছ, মাঠের ফসলসহ সব ভেসে গেছে। আমার খামারের মুরগি ও দোকানের মালামালগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে।” এই চিত্র প্রায় দ্বীপের প্রতিটি প্রান্তের। এতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন বহু মৎস্যচাষি। পাশাপাশি গবাদিপশুর চারণভূমি প্লাবিত হওয়ায় এবং সুপেয় পানির অভাবে মারা যাচ্ছে গরু, ছাগল ও মহিষ।
লবণাক্ততা কেবল কৃষি বা অর্থনীতিতেই নয়, আঘাত হেনেছে জনস্বাস্থ্যেও। স্থানীয় বাসিন্দা রমিজ হাওলাদার বলেন, “লবণ পানির কারণে আমাদের এলাকার স্যানিটেশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে, তাই রোগবালাই বেড়ে গেছে। এই দুর্যোগের সময়ে অসুস্থ কাউকে চরফ্যাশন উপজেলা সদরেও নিয়ে যেতে পারছি না।” একই সুরে কথা বলেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা শামসুল হক মাতব্বর। তিনি বলেন, “লবণ পানির কারণে আমাদের এলাকায় এখন নানা রোগব্যাধি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানবসৃষ্ট সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এ বিষয়ে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. তোতা মিয়া বলেন, “আমাদের উজানে নদীর পানির চাপ কম থাকায় সাগরের পানির ফ্লো ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে লবণাক্ত পানি প্রতি বছরই উপকূলের আরও ভেতরের দিকে উঠে আসছে। এই লবণাক্ত পানির কারণে আমাদের কৃষি ফসল ও মিঠা পানির মাছ অদূর ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।”
এর সাম্প্রতিক উদাহরণ চলতি নিম্নচাপ। এ সময় কুকরি-মুকরির প্রধান স্লুইসগেটের দরজা খোলা থাকায় জোয়ারের পানি খুব সহজে এবং ব্যাপক আকারে লোকালয়ে প্রবেশ করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা যোগ হওয়ায় পানির প্রবাহ যে হারে বাড়ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে দ্বীপটির একটি বড় অংশ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার শঙ্কা অমূলক নয়।
যদি এই ধারা চলতে থাকে, তবে শুধু একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্রই হারাবে না, হাজার হাজার মানুষ তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে, যা এক নতুন মানবিক সংকট তৈরি করবে। এই বিপর্যয় থেকে চর কুকরি-মুকরিকে রক্ষা করতে হলে এখনই জরুরি ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে স্থানীয় বাসিন্দা রমিজ হাওলাদারের দাবি, “আমাদের এলাকার বেড়িবাঁধগুলো আবার নতুন করে সার্ভে করে শক্তিশালী করা দরকার।”
পরিবেশবিদ ও স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন, টেকসই ও উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ, স্লুইসগেটগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা, লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং সুপেয় পানির বিকল্প উৎস নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এই দ্বীপ ও তার বাসিন্দাদের রক্ষা করা সম্ভব।