থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ তীব্রতর হয়েছে, যার ফলে ২৪ জুলাই, ২০২৫-এ থাইল্যান্ডের একটি এফ-১৬ ফাইটার জেট কম্বোডিয়ার সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এই সংঘর্ষে কমপক্ষে দুইজন থাই বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন ৫ বছরের শিশুও রয়েছে। উভয় দেশ একে অপরকে এই সংঘর্ষের জন্য দায়ী করছে।
সংঘর্ষ শুরু হয় বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকালে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত তা মোয়ান থম মন্দিরের কাছে, যা ব্যাংকক থেকে প্রায় ৩৬০ কিলোমিটার দূরে। থাই সেনাবাহিনী জানিয়েছে, কম্বোডিয়ার সেনারা প্রথমে গুলি চালায় এবং সুরিন প্রদেশের কাবচেং জেলায় বেসামরিক এলাকায় আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করে, যার ফলে দুইজন নিহত এবং তিনজন আহত হয়। থাইল্যান্ডের দাবি, কম্বোডিয়া একটি নজরদারি ড্রোন এবং ভারী অস্ত্র, যার মধ্যে বিএম-২১ রকেট লঞ্চার ব্যবহার করেছে। এর জবাবে, থাইল্যান্ড ছয়টি এফ-১৬ জেট প্রস্তুত করেছিল, যার মধ্যে একটি কম্বোডিয়ার একটি সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করেছে। থাই সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রিচা সুকসুওয়ানন বলেন, “আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান শক্তি ব্যবহার করেছি।”
কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই হামলাকে “অন্যায় এবং নৃশংস সামরিক আগ্রাসন” হিসেবে নিন্দা করেছে এবং দাবি করেছে যে থাই সেনারা প্রথমে আক্রমণ শুরু করেছে। তারা জানিয়েছে, থাই এফ-১৬ জেট দুটি বোমা ফেলেছে একটি সড়কে, যা কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডের মধ্যে রয়েছে। কম্বোডিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হুন সেন ফেসবুকে জানিয়েছেন, থাই সামরিক বাহিনী দুটি কম্বোডিয়ান প্রদেশে গোলাবর্ষণ করেছে।
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের বিভিন্ন অংশে গত এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিরোধ চলছে। ২০১১ সালে এক সপ্তাহব্যাপী আর্টিলারি বিনিময়ে কমপক্ষে এক ডজন মানুষ নিহত হয়েছিল। এই বছরের মে মাসে একজন কম্বোডিয়ান সৈন্যের মৃত্যুর পর থেকে উত্তেজনা নতুন করে শুরু হয়, যা পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। গত বুধবার (২৩ জুলাই), থাইল্যান্ড দাবি করে যে কম্বোডিয়া সীমান্তে নতুন রাশিয়ান তৈরি ল্যান্ডমাইন স্থাপন করেছে, যাতে পাঁচজন থাই সৈন্য আহত হয়েছে। কম্বোডিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, সৈন্যরা সম্মত পথ থেকে সরে গিয়ে পুরনো মাইনের কারণে আহত হয়েছে।
এই ঘটনার পর থাইল্যান্ড কম্বোডিয়া থেকে তার রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে এবং কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে ব্যাংকক থেকে বহিষ্কার করে। কম্বোডিয়াও তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ককে “সেকেন্ড চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্স” স্তরে নামিয়ে আনে এবং ব্যাংকক থেকে তাদের সব কূটনীতিককে প্রত্যাহার করে। থাইল্যান্ড পুরো সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এবং নাগরিকদের কম্বোডিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
থাইল্যান্ডের সুরিন প্রদেশে কাবচেং জেলার প্রায় ৪০,০০০ বাসিন্দাকে ৮৬টি গ্রাম থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থাইল্যান্ডের এই হামলাকে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য “গুরুতর হুমকি” হিসেবে অভিহিত করেছে এবং তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় “সর্বোচ্চ মূল্যে” প্রতিরক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কম্বোডিয়ার বর্তমান নেতা হুন মানেট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে জরুরি বৈঠক আহ্বানের আবেদন জানিয়েছেন।
থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই পরিস্থিতিকে “সূক্ষ্ম” হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলবে। তবে, থাই প্রধানমন্ত্রী পায়েতোংতার্ন শিনাওয়াত্রার সাম্প্রতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, যিনি কম্বোডিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সাথে ফোনে কথা বলেছিলেন, বিতর্কের সৃষ্টি করে। এই কথোপকথনের বিষয়বস্তু ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তিনি আদালতের নির্দেশে সাময়িকভাবে সাসপেন্ড হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই সংঘর্ষের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীন কম্বোডিয়ায় থাকা তার নাগরিকদের সীমান্ত এলাকা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে, এবং যুক্তরাজ্য তার নাগরিকদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে চলতে বলেছে।
এই সংঘর্ষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি। থাইল্যান্ডের সামরিক শক্তি, বিশেষ করে এর বিমান বাহিনী, কম্বোডিয়ার তুলনায় অনেক বেশি উন্নত, যেখানে থাইল্যান্ডের ৩,৬১,০০০ সক্রিয় সৈন্য এবং আধুনিক অস্ত্র রয়েছে। তবে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংঘর্ষ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম, যদিও বর্তমানে উভয় দেশের নেতৃত্বের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব রয়েছে।