ভোলায় ইউপি সদস্যকে কোস্টগার্ড অফিসে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ, বিচারের দাবিতে মানববন্ধন
ভোলা জেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের তিনবারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য মো. হিরন বাকলাইকে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে অপহরণ করে কোস্টগার্ড অফিসে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয়রা এক বিশাল মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছেন।
মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) বিকেলে ভেলুমিয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের পুলিশ ফাঁড়ির সামনে হাজারো মানুষ জড়ো হয়ে এই মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভায় অংশ নেন। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ইউপি সদস্য হিরন বাকলাইয়ের ওপর চালানো নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে অভিযুক্ত কোস্টগার্ড সদস্য সাখাওয়াত হোসেন ও তার সহযোগীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
ঘটনার সূত্রপাত হয় জমিজমা সংক্রান্ত পুরনো বিরোধ থেকে। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, কোস্টগার্ড সদস্য সাখাওয়াত হোসেনের পিতা ইউনুছ ডাকুয়া একসময় হিরন বাকলাইয়ের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে কিছু জমি ক্রয় করেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে তারা ক্রয়কৃত জমির চেয়ে বেশি জায়গা দখলে রেখেছেন। বিষয়টি নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল, যা স্থানীয় সালিশে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। সালিশদারদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জমির পরিমাণ নির্ধারণ করে পিলার স্থাপন করা হয় এবং উভয়পক্ষ এই রায় মেনে নেয়।
কিন্তু ২৪ জানুয়ারি সাখাওয়াতের পরিবার সালিশের সিদ্ধান্ত অমান্য করে পিলার উঠিয়ে ফেলে এবং নতুন করে বেড়া দেয়। বিষয়টি জানার পর হিরন বাকলাই ও তার স্বজনরা ঘটনাস্থলে যান এবং সালিশদারদের জানিয়ে বেড়া অপসারণ করেন। তখন সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যান।
কিছুক্ষণ পর কোস্টগার্ড সদস্য সাখাওয়াত হোসেন হিরন বাকলাইকে ফোন করে জমির সীমানা বুঝিয়ে দিতে বলেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হিরন বাকলাই ঘটনাস্থলে গেলে সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষমাণ সাখাওয়াত ও তার সহযোগীরা তাকে জোরপূর্বক ধরে কোস্টগার্ডের গাড়িতে তোলে। স্থানীয়রা বাধা দিলে কোস্টগার্ড সদস্যরা জানান, তারা শুধুমাত্র জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হিরন বাকলাইকে খেয়াঘাট অফিসে নিয়ে যাচ্ছেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও হিরন বাকলাই ফিরে না আসায় তার পরিবার ও স্বজনরা কোস্টগার্ড অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে গেলে জানানো হয়, তিনি সেখানে নেই। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর পরিবারের সদস্যরা থানায় গিয়ে তাকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তার পুরো শরীরে গুরুতর নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। পুলিশ পরে স্ট্যাম্পে লিখিত নেওয়ার পর তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে, এবং তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হিরন বাকলাই বর্তমানে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকদের মতে, তার শরীরের প্রায় সব জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে, বিশেষ করে মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছে, যা তার জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের কাছে হিরন বাকলাই জানান, কোস্টগার্ড অফিসে নেওয়ার পর তাকে দফায় দফায় মারধর করা হয়। এমনকি পায়খানার রাস্তার ওপরও আঘাত করা হয়েছে। কোস্টগার্ড সদস্যরা তাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে বলেন, যদি তিনি এ বিষয়ে মুখ খোলেন, তবে তার জীবন শেষ করে দেওয়া হবে।
এই ঘটনার পর কোস্টগার্ড সদস্য সাখাওয়াত হোসেন ও তার সহযোগীরা হিরন বাকলাইয়ের পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিতে থাকে। তারা বলে, হিরন বাকলাইয়ের যে অবস্থা করা হয়েছে, আরও বাড়াবাড়ি করলে তার চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি হবে। প্রয়োজনে বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করেও তাদের দেখে নেওয়া হবে এবং যেকোনো সময় ক্রসফায়ারে দেওয়া হতে পারে।
এই ভয়ংকর ঘটনার পর ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী মঙ্গলবার বিকেলে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। এতে অংশ নেওয়া নারী-পুরুষ সবাই একসঙ্গে স্লোগান দেন এবং অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, যাদের মধ্যে ছিলেন হাজী মো. হারুন অর রশীদ, মো. আমির হোসেন, মো. জাহিদুল, মো. ফোরকান, মো. জাকির, মো. নজরুল খানসহ আরও অনেকে।
স্থানীয় নেতারা প্রশাসনের কাছে এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। তবে এ বিষয়ে অভিযুক্ত কোস্টগার্ড সদস্য সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে স্থানীয়রা দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন, যাতে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আর না ঘটে এবং দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়।