
গ্রামের আকাশটা সেদিন সন্ধ্যার দিকে থেকেই ভারী হয়ে উঠেছিল। পশ্চিম আকাশে কালো মেঘের ঘন ঘটা, সঙ্গে মৃদু বাতাস। কৃষকরা তখনও মাঠে ব্যস্ত—পাকা ধান কাটা প্রায় শেষের পথে। সোনালী ধানের গন্ধে চারদিক মাতোয়ারা, সবাই আশা করছিল এবারের ফসলটা ভালোই হবে। কিন্তু প্রকৃতির মেজাজ কে বোঝে! রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি, যা মুহূর্তের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হলো।বৃষ্টি পড়তে লাগল একটানা, যেন আকাশের বুক ফেটে জল নেমে আসছে। রাতভর বজ্রপাত আর ঝড়ো হাওয়ায় গ্রামের সবাই ঘরে আশ্রয় নিল। চারপাশে কেবল বৃষ্টির শব্দ, টিনের চালে টুপটাপ শব্দে ঘুম আসছিল না কারও। পরদিন সকালে যখন বৃষ্টি থামল, গ্রামের মানুষজন মাঠে গিয়ে যে দৃশ্য দেখল, তাতে সবার বুক হাহাকার করে উঠল।পাকা ধান যেগুলো কাটা হয়নি, সেগুলো জলে ডুবে গেছে। কোথাও গোছাগোছি করা ধান ভেসে গেছে, কোথাও আবার কাদায় মিশে একাকার। পানির তোড়ে অনেক জমির মাটি ভেসে গিয়েছে। কৃষকরা মাঠে দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল—সারা বছরের পরিশ্রম যেন এক রাতেই ধুয়ে গেল। কেউ কাঁধে হাত রেখে অন্যকে সান্ত্বনা দিল, কেউ বা চোখ মুছতে মুছতে বলল, “ভাগ্য বুঝি আমাদের এমনই!”তবু গ্রামের জীবনে শুধু হাহাকার নয়, আছে আনন্দের সুরও। দুপুরের দিকে যখন সূর্যটা একটু উঁকি দিল, তখন অন্যরকম দৃশ্য দেখা গেল পুকুর, ডোবা আর খেতের চারপাশে। বৃষ্টির জলে চারদিক টইটম্বুর হয়ে গেছে, আর সেই জলেই দেখা মিলল ছোট-বড় নানা রকম মাছের। কেউ হাতে গামছা, কেউ ঝাঁকি জাল, কেউ বা ছোট খইনি নিয়ে নেমে পড়ল মাছ ধরার উৎসবে। শিশু, কিশোর, তরুণ—সবার মুখে উচ্ছ্বাসের ঝলক।
মাছ ধরার সেই হৈচৈ গ্রামে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার করল। কেউ পেল শিং, কেউ কৈ, কেউবা বোয়াল বা ট্যাংরা। হাসি-ঠাট্টায় ভরে উঠল নদীর ধারে ও খেতের আল। একপাশে কৃষকের চোখে দুঃখের ছাপ, অন্যপাশে গ্রামীণ জীবনের সহজ আনন্দ। প্রকৃতি যেন একসঙ্গে কান্না আর হাসি দুটোই উপহার দিল সেই দিনে।
বিকেলের দিকে যখন আকাশে হালকা রোদ উঠল, গ্রামের মহিলারা ঘাটে বসে ভেজা ধান রোদে শুকোতে লাগল। কেউ আবার তাজা মাছ রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে—চুলায় ধোঁয়া উঠছে, ছেলেমেয়েরা হাঁসফাঁস করছে মাছের জন্য। ধান হারানোর কষ্ট যেন সাময়িক ভুলে গেল সবাই।
প্রকৃতি এমনই—একদিকে ধ্বংস, অন্যদিকে সৃজন। কৃষক জানে, এবার ক্ষতি হলেও পরের মৌসুমে সে আবার মাঠে নামবে। এই বিশ্বাসই তাকে টিকিয়ে রাখে। বৃষ্টির ক্ষয়ক্ষতি যেমন ধানের জমি নষ্ট করেছে, তেমনি সেই বৃষ্টিই এনে দিয়েছে একদিনের প্রাণবন্ত হাসি, মাছ ধরার আনন্দ আর নতুন করে বাঁচার প্রেরণা।এই ঘটনাটি আমাদের শেখায়, জীবনের সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, আশা-নিরাশা সবই একসূত্রে গাঁথা। প্রকৃতি কখনো কঠিন, কখনো উদার। মানুষের জীবনে যেমন বেদনা আসে, তেমনি আনন্দও আসে অপ্রত্যাশিত পথে। হঠাৎ এক রাতের বৃষ্টি ধান নষ্ট করলেও, সেই বৃষ্টিই আবার নিয়ে আসে গ্রামের চেনা হাসির মুখগুলো—মাছ ধরার আনন্দে।