চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বেইজিংয়ে দেশটির এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছেন, যেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে শি শান্তি ও যুদ্ধের মধ্যে বিশ্বের পছন্দের উপর জোর দিয়েছেন এবং চীনের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেছেন। এই ইভেন্টটি চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সম্ভাব্য নিবিড় সম্পর্কের ইঙ্গিতও দিয়েছে।
বেইজিং, ৩ সেপ্টেম্বর: মঙ্গলবার সকাল ৯টায় (বেইজিং সময়) তিয়ানানমেন স্কয়ারে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে একটি বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন উপস্থিত ছিলেন। এই কুচকাওয়াজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের ৮০তম বার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে আয়োজিত হয়, যা চীনের “বিজয় দিবস” হিসেবে পালিত হয়। শি তার বক্তৃতায় বলেন, “বিশ্বকে শান্তি ও যুদ্ধের মধ্যে পছন্দ করতে হবে। চীন কখনো কোনো হুমকির কাছে মাথা নত করবে না এবং এর উত্থান অপ্রতিরোধ্য।
৭০ মিনিটব্যাপী এই কুচকাওয়াজে চীনের অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম প্রদর্শিত হয়, যার মধ্যে ছিল স্টিলথ ফাইটার জেট (জে-২০), হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ডিএফ-৬১), এবং দুটি নতুন বড় আকারের পানির নিচের ড্রোন। এছাড়া, স্থল ও সমুদ্রে ব্যবহারের জন্য নতুন লেজার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রোবটিক ডগ ড্রোনও প্রদর্শিত হয়। এই অস্ত্রশস্ত্র চীনের সামরিক শক্তি এবং তাইওয়ানের মতো সম্ভাব্য সংঘাতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
শি জিনপিংয়ের পাশে পুতিন এবং কিমের উপস্থিতি এই তিন নেতার মধ্যে একটি শক্তিশালী সংহতি প্রকাশ করে, যা পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য তাদের যৌথ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক। এটি প্রথমবারের মতো শি, পুতিন এবং কিম একসঙ্গে প্রকাশ্যে উপস্থিত হলেন, যাকে বিশ্লেষকরা “অশান্তির অক্ষ” (Axis of Upheaval) হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই ইভেন্টে ২৬ জন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান উপস্থিত ছিলেন, যার মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং, এবং বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো উল্লেখযোগ্য। তবে, পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো এবং সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিচ উপস্থিত ছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ইভেন্টে উপস্থিত ছিলেন না এবং ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্টে শি, পুতিন এবং কিমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনারা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, তখন ভ্লাদিমির পুতিন এবং কিম জং উনের প্রতি আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাই।” তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের স্বাধীনতা অর্জনে মার্কিন ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন। তবে, ট্রাম্প আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে তিনি এই কুচকাওয়াজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন না।
কিম জং উনের এই সফর ছিল ২০১৯ সালের পর তার প্রথম চীন সফর এবং তার প্রথম বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক ইভেন্টে অংশগ্রহণ। তিনি তার মেয়ে কিম জু এ-এর সঙ্গে বেইজিংয়ে পৌঁছান, যাকে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা তার উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করে। কিমের উপস্থিতি উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে চীনের উপর নির্ভরতার পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই কুচকাওয়াজ চীনের ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব এবং পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি বার্তা। শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীন একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়, যেখানে রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই ইভেন্টের মাধ্যমে শি তার দেশের সামরিক শক্তি এবং কূটনৈতিক প্রভাব প্রদর্শন করেছেন, যা তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মতো বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।