সাম্প্রতিক একাডেমিক গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, প্রযুক্তি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং রোবোটিক্স, এখন নতুন চাকরি সৃষ্টির তুলনায় বেশি চাকরি ধ্বংস করছে। এই প্রবণতা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি হ্রাস (ডিফ্লেশন), সরকারের আয় হস্তান্তরে বর্ধিত ভূমিকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো প্রযুক্তি নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা।
গবেষণা অনুযায়ী, কম্পিউটিং শক্তির দ্রুত অগ্রগতির কারণে এআই আগামী কয়েক দশকে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চাকরি স্বয়ংক্রিয় করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, এআই বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০% চাকরির উপর প্রভাব ফেলতে পারে, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে এই হার ৬০% পর্যন্ত উঠতে পারে। এই স্বয়ংক্রিয়করণ নিম্ন-দক্ষতার চাকরিগুলোকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে, যার ফলে কাঠামোগত বেকারত্ব এবং আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
তবে, চীনের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এআই-এর প্রভাব ভিন্ন। গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের শ্রমবাজারে এআই প্রয়োগ সামগ্রিকভাবে মজুরি বৃদ্ধি করেছে এবং নির্বাহী ও সাধারণ কর্মীদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য কমিয়েছে। এটি মূলত রুটিন কাজের স্থানে সৃজনশীল এবং সামাজিক কাজের সৃষ্টির কারণে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবহন খাতে এআই প্রযুক্তি দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে এবং নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করেছে। তবে, চীনে ২০৪৯ সালের মধ্যে ৩৫.৮% শ্রমশক্তি (প্রায় ২৭৮ মিলিয়ন শ্রমিক) এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এআই গ্রহণ তুলনামূলকভাবে বেশি চাকরি হ্রাসের দিকে নিয়ে গেছে, বিশেষ করে উৎপাদন এবং নিম্ন-দক্ষতার সেবা খাতে। ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এআই গ্রহণের উচ্চ হারের অঞ্চলগুলোতে কর্মসংস্থান-জনসংখ্যা অনুপাত উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই প্রভাব পুরুষ, মধ্য-দক্ষতার শ্রমিক এবং বয়স্ক কর্মীদের উপর বেশি প্রকট।
এআই-চালিত স্বয়ংক্রিয়করণ ডিফ্লেশনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, কারণ উৎপাদন খরচ কমে এবং পণ্য ও সেবার দাম হ্রাস পায়। তবে, এটি আয় বৈষম্য বাড়াতে পারে, কারণ উচ্চ-দক্ষতার শ্রমিক এবং প্রযুক্তি মালিকরা এআই-এর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সুবিধা ভোগ করেন, যেখানে নিম্ন-দক্ষতার শ্রমিকরা চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, এআই বর্তমানে কর্মসংস্থানের তুলনায় মজুরির উপর বেশি প্রভাব ফেলছে, যা আয় বৈষম্যকে আরও তীব্র করতে পারে।
এআই-এর কারণে ব্যাপক চাকরি হ্রাসের সম্ভাবনা সরকারের ভূমিকাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে। সামাজিক নিরাপত্তা জাল শক্তিশালী করা, পুনঃপ্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা এবং আয় হস্তান্তর নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারগুলো এই প্রভাব মোকাবেলা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, চীনে সরকার এআই গ্রহণের পাশাপাশি শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়নের উপর জোর দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, শ্রমবাজারের অভিযোজন এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামো উন্নত করার উপর ফোকাস করা হচ্ছে।
এআই প্রযুক্তিতে নেতৃত্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এআই-সংক্রান্ত বিনিয়োগে ৬৭.২ বিলিয়ন ডলার আকর্ষণ করেছে, যা চীনের তুলনায় ৮.৭ গুণ বেশি। তবে, চীন পেটেন্ট এবং শিল্প প্রয়োগের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে, বিশেষ করে উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবহনে। চীনের সরকার-চালিত এআই কৌশল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার-চালিত মডেলের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে পুনর্নির্মাণ করছে।
এআই এবং রোবোটিক্সের দ্রুত অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী শ্রমবাজারকে পুনর্গঠন করছে, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য, ডিফ্লেশন এবং সরকারি নীতির নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। যদিও এআই উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, তবে এর সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক প্রভাব মোকাবেলায় শক্তিশালী নীতি এবং পুনঃপ্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা এআই-এর ভবিষ্যৎ এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাবকে আরও জটিল করে তুলছে।