বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে অবস্থিত ১,৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পটুয়াখালী আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যার নির্মাণ ব্যয় প্রায় ২৫৪ কোটি মার্কিন ডলার, দীর্ঘমেয়াদি কয়লা সরবরাহ চুক্তির অভাবে কার্যত অচল পড়ে আছে। চীনা কনসোর্টিয়াম (TEPC, CHEC, CWEC) কর্তৃক নির্মিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট (প্রতিটি ৬৬০ মেগাওয়াট) পরীক্ষামূলকভাবে চালু হলেও, বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিশাল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ অলস অবস্থায় আটকে আছে, এবং প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনাকারী আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড (RNPL) গত জানুয়ারি ২০২৪ থেকে তিনবার কয়লা সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। প্রতিবারই শুধুমাত্র সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়ংতাই এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেড (Yongtai Energy) প্রযুক্তিগতভাবে যোগ্য দরদাতা হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, দরপত্রের শর্তাবলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে অন্য সম্ভাব্য সরবরাহকারীরা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেনি। এর ফলে ইয়ংতাই উচ্চমূল্যে কয়লা সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
ইয়ংতাই বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার বুকিত আসাম খনি থেকে পরীক্ষামূলক চালানোর জন্য ১০ লাখ টন কয়লা সরবরাহ করছে, এবং সম্প্রতি আরও ১২৮,০০০ টন কয়লা সরবরাহের চুক্তি করেছে। তবে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির জন্য তাদের উচ্চ মূল্যের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিবেচিত হচ্ছে।
দরপত্রের ১৮৬ পৃষ্ঠার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শর্তাবলি একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির (ইয়ংতাই) জন্য উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
RNPL প্রচলিত ‘দুই ধাপ দুই খাম’ পদ্ধতির পরিবর্তে ‘এক ধাপ দুই খাম’ পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, যেখানে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক প্রস্তাব একসঙ্গে জমা দিতে হয়। প্রযুক্তিগত প্রস্তাব বাতিল হলে আর্থিক প্রস্তাব খোলা হয় না, ফলে দরদাতারা দ্বিতীয় সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এই পদ্ধতি রামপাল ও মাতারবাড়ির মতো বড় প্রকল্পে ব্যবহৃত দুই ধাপের পদ্ধতির তুলনায় কম স্বচ্ছ।
এছাড়া, দরপত্রের আগে কোনো প্রি-বিড মিটিং অনুষ্ঠিত হয়নি, যা সাধারণত সম্ভাব্য দরদাতাদের শর্তাবলি স্পষ্ট করতে এবং অংশগ্রহণ বাড়াতে সহায়ক। তৃতীয় দফায় ১০টি কোম্পানি দরপত্রের কাগজ কিনলেও মাত্র চারটি প্রস্তাব জমা দেয়, এবং শুধুমাত্র ইয়ংতাই প্রযুক্তিগতভাবে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
তাছাড়া, মার্চ ২০২৫-এ দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুটি কোম্পানি (ইউনাইটেড পাওয়ার এবং সেনা কল্যাণ সংস্থা) সময়সীমার পরে প্রস্তাব জমা দেয়, যা বাতিল করা হয়। এই ঘটনা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে আরও প্রশ্ন তুলেছে।
প্রকল্পের ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো একে অপরের উপর দোষ চাপাচ্ছে। RNPL-এর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম ভূঁইয়া দাবি করেন, দরপত্রের নকশা ও মূল্যায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (BPDB)। অন্যদিকে, BPDB-এর চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, শর্তাবলি নির্ধারণ করেছে RNPL-এর বোর্ড, এবং তাদের বারবার শর্ত সহজ করার পরামর্শ দেওয়া সত্ত্বেও তারা আরও কঠোর শর্ত আরোপ করেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফউজুল কবির খান দরপত্র প্রক্রিয়ার ত্রুটি তদন্তের জন্য একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা। কমিটি প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ প্রদান করবে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইউনিট-১ এবং জুনে ইউনিট-২ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়ার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মোট ১,২৪৪ মেগাওয়াট নিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তবে, বর্তমানে কয়লার অভাবে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় প্রায় ১২ টাকা, যা দেশের গড় ৬-৭ টাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এর মূল কারণ একক সরবরাহকারী এবং দরপত্রে প্রতিযোগিতার অভাব।
প্রতিদিন প্রায় ১২,০০০ টন কয়লার প্রয়োজন হবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে, যা ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা হবে। RNPL ২০১৯ সালে টপ হ্যান্ড কনসাল্টিং এবং উড ম্যাকেঞ্জি (অস্ট্রেলিয়া)-এর সঙ্গে কয়লা সংগ্রহের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
BPDB জানিয়েছে, দরপত্রের শর্ত সহজ করে নতুনভাবে আহ্বান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছরের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পরিবর্তে এক বছরের স্বল্পমেয়াদি চুক্তিও বিবেচনা করা হচ্ছে। BPDB-এর চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, “২৫০ কোটি ডলারের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এভাবে অলস থাকতে পারে না। শিগগিরই কার্যকর সমাধানে যেতে হবে, নইলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় বাড়বে।”
ইয়ংতাই এনার্জি কয়লার মূল্য পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব দিয়েছে, তবে ফউজুল কবির বলেছেন, “দরপত্র প্রক্রিয়ার মাঝপথে মূল্য পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই।” RNPL-কে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হবে।