ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (IDF) রবিবার (২৭ জুলাই, ২০২৫) গাজার তিনটি নির্দিষ্ট এলাকায়—আল-মাওয়াসি, দেইর আল-বালাহ, এবং গাজা সিটি—সামরিক অভিযানে একটি “কৌশলগত বিরতি” ঘোষণা করেছে। এই বিরতি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা (গ্রিনিচ মান সময় সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা) পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, যতক্ষণ না পরবর্তী নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হলো চলমান সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত গাজার বেসামরিক জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদান সহজতর করা এবং অঞ্চলটির ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট মোকাবেলা করা।
বিরতি আল-মাওয়াসি, দেইর আল-বালাহ, এবং গাজা সিটিতে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কার্যকর হবে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, এই এলাকাগুলোতে বর্তমানে তাদের স্থল সৈন্য অভিযান পরিচালনা করছে না, যদিও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এই এলাকাগুলোতে সংঘর্ষ এবং বিমান হামলা হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জাতিসংঘের ত্রাণ কনভয়গুলোর জন্য নিরাপদ পথ স্থাপন করেছে, যা প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খাদ্য, ওষুধ, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ বিতরণের জন্য ব্যবহৃত হবে।
ইসরায়েলি বিমান বাহিনী ২৬ জুলাই থেকে গাজায় ত্রাণের এয়ারড্রপ পুনরায় শুরু করেছে, যার মধ্যে ময়দা, চিনি, এবং টিনজাত খাবার রয়েছে। এটি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম এয়ারড্রপ অভিযান।
মিশরের রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ থাকলেও, মিশরের আল কাহেরা নিউজ টিভি জানিয়েছে, ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো ইসরায়েলের মাধ্যমে গাজায় প্রবেশের জন্য মিশর থেকে রওনা হয়েছে। এই ট্রাকগুলো ইসরায়েলি নিরাপত্তা পরীক্ষার পর গাজায় প্রবেশ করবে।
গাজায় মার্চ ২০২৫ থেকে ইসরায়েলের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে খাদ্য, জ্বালানি, পানি, এবং ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ এবং ত্রাণ সংস্থাগুলো দুর্ভিক্ষের সতর্কতা জারি করেছে, এবং মে মাসে একটি বৈশ্বিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষক জানিয়েছে, গাজার ৫ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। জুন ২০২৫-এ গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF)-এর ত্রাণ বিতরণ স্থানের কাছে ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে ২৭ জন নিহত হওয়ার পর ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ এবং ত্রাণ সংস্থাগুলো, গাজায় ত্রাণ প্রবেশের জন্য ইসরায়েলের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদন হামাসের ত্রাণ চুরির অভিযোগ খণ্ডন করার পর এই বিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং সামরিক নেতৃত্বের নির্দেশে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে IDF জানিয়েছে।
ইসরায়েল দাবি করেছে, হামাস ত্রাণ সরবরাহ লুট করে তাদের সামরিক কার্যক্রমে ব্যবহার করে, যদিও ত্রাণকর্মীরা এই অভিযোগের ব্যাপক প্রমাণ অস্বীকার করেছে। এই বিরতির মাধ্যমে ইসরায়েল হামাসের হাতে ত্রাণ পড়া রোধ করতে এবং মানবিক সংকটের জন্য তাদের দায় অস্বীকার করতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিস (OCHA) এবং অন্যান্য ত্রাণ সংস্থা ইসরায়েলের পূর্ববর্তী প্রস্তাবিত ত্রাণ বিতরণ পরিকল্পনাকে—যেখানে বেসরকারি ঠিকাদার এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা ত্রাণ বিতরণের কথা বলা হয়েছিল—মানবিক নীতির লঙ্ঘন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা এই বিরতিকে স্বাগত জানালেও সতর্ক করেছে যে, এটি গাজার ২.৩ মিলিয়ন মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।
এক্স-এ পোস্টগুলোতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ এই বিরতিকে মানবিক সংকট মোকাবেলায় একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, অন্যরা এটিকে গাজায় দুর্ভিক্ষের জন্য ইসরায়েলের দায় এড়ানোর একটি “প্রচারণামূলক” পদক্ষেপ হিসেবে সমালোচনা করেছেন।
৭ অক্টোবর, ২০২৩-এ হামাসের নেতৃত্বাধীন হামলায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করার পর ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক অভিযানে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৫৩,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫-এ একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, কিন্তু মার্চ মাসে তা ভেঙে যায়, এবং ইসরায়েল ত্রাণ প্রবেশে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
মে ২০২৫-এ ইসরায়েল “গিদিয়ন’স চ্যারিয়টস” নামে একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করে, যার মাধ্যমে গাজার পুনরায় দখল এবং বেসরকারি ঠিকাদারদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের কথা বলা হয়। এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং বাস্তবায়িত হয়নি।
হামাস এখনও ৫৮ জন জিম্মিকে আটক রেখেছে, যাদের অর্ধেকের মৃত বলে ধারণা করা হয়। ইসরায়েল জিম্মিদের মুক্তি এবং হামাসের ধ্বংসকে তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ত্রাণ সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে যে, তিনটি এলাকায় ১০ ঘণ্টার বিরতি গাজার বিশাল মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য অপর্যাপ্ত। গাজার ৯০% জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত, এবং অপুষ্টি, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে, ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পূর্ববর্তী ত্রাণ বিতরণে ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা নিরাপদ ত্রাণ বিতরণের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে। GHF ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে নিরাপদ পথ নিশ্চিত করতে এবং বেসামরিক নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ উন্নত করার আহ্বান জানিয়েছে।
এক্স-এ কিছু ব্যবহারকারী এই বিরতিকে ইসরায়েলের “ইমেজ ব্যবস্থাপনা” হিসেবে সমালোচনা করেছেন, দাবি করে যে এটি আন্তর্জাতিক সমালোচনা এড়ানোর একটি কৌশল, যখন গাজায় দুর্ভিক্ষের অবস্থা চরমে পৌঁছেছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর গাজার তিনটি এলাকায় ঘোষিত অস্থায়ী বিরতি অঞ্চলটির গুরুতর মানবিক সংকট মোকাবেলায় একটি পদক্ষেপ, যা আন্তর্জাতিক চাপ এবং ত্রাণ সংস্থাগুলোর সতর্কতার পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া হয়েছে। যদিও এই বিরতি ত্রাণ প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তবে এর সীমিত পরিধি এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো গাজার ২.৩ মিলিয়ন মানুষের সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আগামী দিনগুলোতে এই বিরতির কার্যকারিতা এবং এর মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের সাফল্য গাজার মানবিক পরিস্থিতির উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।