ইস্তাম্বুলে সর্বশেষ শান্তি আলোচনা শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেন এবং রাশিয়া একে অপরের বিরুদ্ধে ড্রোন হামলা চালিয়েছে, যা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান যুদ্ধে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। আলোচনায় বন্দী বিনিময় নিয়ে আলোচনা হলেও যুদ্ধবিরতি এবং নেতাদের সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে গভীর মতপার্থক্য অব্যাহত রয়েছে।
ইউক্রেন রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলে ড্রোন হামলা চালিয়েছে, যার ফলে একজন নিহত এবং বেশ কয়েকটি জ্বালানি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী প্রায়শই রাশিয়ার শক্তি-সম্পর্কিত স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে দূরপাল্লার ড্রোন হামলা চালায়।
রাশিয়া ইউক্রেনের ওডেসা এবং চেরকাসি অঞ্চলে ১০৩টি ড্রোন এবং চারটি মিসাইল দিয়ে হামলা চালিয়েছে, যা বন্দর এবং রেল স্থাপনাগুলোতে আঘাত হেনেছে। এই হামলায় শস্য রপ্তানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেনের বিমান বাহিনী জানিয়েছে, তারা ৫১টি ড্রোন ধ্বংস করেছে, ৪৬টি ইলেকট্রনিকভাবে নিষ্ক্রিয় করেছে, এবং তিনটি ড্রোন রাশিয়ায় ফিরে গেছে।
রাশিয়ার হামলায় ওডেসায় একটি আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে একজন নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়েছেন। চেরকাসিতে একটি অবকাঠামো স্থাপনায় আঘাত হানা হয়েছে, যার ফলে ছয়জন আহত হয়েছেন। ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলাকে “রাশিয়ার সন্ত্রাসের আরেকটি রাত” হিসেবে বর্ণনা করে কঠোর নিন্দা জানিয়েছে।
ইস্তাম্বুলের সিরাগান প্রাসাদে অনুষ্ঠিত আলোচনায় ইউক্রেনের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ, এবং রাশিয়ার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ভ্লাদিমির মেদিনস্কি। আলোচনা মাত্র এক ঘণ্টারও কম সময় স্থায়ী হয় এবং নিম্নলিখিত ফলাফল উত্থাপিত হয়:
উভয় পক্ষ তরুণ, গুরুতরভাবে আহত বন্দী এবং ১২,০০০ নিহত সৈন্যের দেহাবশেষ ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। তবে, রাশিয়া অভিযোগ করেছে যে ইউক্রেন এই বিনিময় স্থগিত করেছে।
ইউক্রেন একটি ৩০ দিনের নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে, যা রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে। রাশিয়া ফ্রন্টলাইনের নির্দিষ্ট অংশে দুই থেকে তিন দিনের সাময়িক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে, তবে ইউক্রেন এটিকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করে।
ইউক্রেন একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তি পরিকল্পনার রোডম্যাপ উপস্থাপন করেছে, যার মধ্যে যুদ্ধবিরতি, বন্দী বিনিময়, এবং রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় শিশুদের প্রত্যাবর্তন অন্তর্ভুক্ত। রাশিয়া এই প্রস্তাবকে “অগ্রহণযোগ্য” হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝিয়া, এবং খেরসন অঞ্চল থেকে ইউক্রেনের সামরিক প্রত্যাহার, সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ, এবং ন্যাটো সদস্যপদ থেকে বিরত থাকার শর্ত আরোপ করেছে।
ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, “ইউক্রেন কখনো এই যুদ্ধ চায়নি, এবং রাশিয়াকেই এটি শেষ করতে হবে।” তিনি আলোচনায় নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি এবং শিশুদের প্রত্যাবর্তনের উপর জোর দিয়েছেন।
রাশিয়ার প্রতিনিধিরা আলোচনায় কোনো “অলৌকিক অগ্রগতি” আশা করেনি এবং কঠোর শর্ত আরোপ করেছে, যা ইউক্রেনের কাছে আত্মসমর্পণের সমতুল্য।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয় পক্ষের উপর যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন, তবে তার প্রচেষ্টা এখনও কোনো উল্লেখযোগ্য ফলাফল আনতে পারেনি। ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপে কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেননি।
এর আগে জুন ২০২৫-এ ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনায়ও কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়নি, তবে বন্দী বিনিময়ে অগ্রগতি হয়েছিল। ইউক্রেনের “অপারেশন স্পাইডার’স ওয়েব” নামে পরিচিত একটি বড় আকারের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার ৪০টিরও বেশি সামরিক বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা যুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এই হামলার পর রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পাল্টা হামলা চালায়, যার মধ্যে ৪৭৯টি ড্রোন এবং ২০টি মিসাইল ব্যবহৃত হয়।
ইস্তাম্বুল শান্তি আলোচনা সত্ত্বেও ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে সামরিক উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। ড্রোন হামলাগুলো উভয় পক্ষের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস এবং আলোচনায় অগ্রগতির অভাবকে তুলে ধরে। যুদ্ধবিরতি বা দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তির সম্ভাবনা এখনও অনিশ্চিত, এবং আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও উভয় পক্ষ তাদের কঠোর অবস্থানে অটল রয়েছে। আগামী দিনগুলোতে বন্দী বিনিময় এবং সম্ভাব্য আরেকটি আলোচনার দিকে নজর থাকবে, তবে বর্তমান পরিস্থিতি শান্তির পথে বড় বাধার ইঙ্গিত দেয়।