অপরিচ্ছন্ন ড্রেন, ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হওয়া খাল ও পুকুর এবং অপর্যাপ্ত মশক নিধন কার্যক্রম—এই তিনে মিলে ভোলা পৌরসভা এখন যেন মশার এক বিশাল প্রজনন ক্ষেত্র। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই এডিস মশার ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে, যার ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। শহরের কেন্দ্রস্থলে নামমাত্র পরিচ্ছন্নতা অভিযান চললেও, পৌরসভার বেশিরভাগ প্রান্তিক এলাকা কর্তৃপক্ষের অবহেলার শিকার। ফলে মশার উপদ্রবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর চাপ।
এই সংকটের এক জীবন্ত উদাহরণ পৌর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়াজিদিয়া মসজিদ সড়কের বাসিন্দা মো. আওলাদ হোসেনের পরিবার। তাঁর অনার্স পড়ুয়া ছেলে রাতুল (২৩) বাড়ির পাশের অপরিচ্ছন্ন ড্রেনে জন্মানো মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত তিন দিন ধরে ভোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি। ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে আওলাদ হোসেন বলেন, “প্রায় এক বছর ধরে আমাদের এলাকার ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয় না। পৌরসভার লোকজন মাঝে মাঝে রাস্তার পাশ দিয়ে দায়সারাভাবে ওষুধ ছিটিয়ে যায়, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না। ড্রেনের নোংরা পানিতেই মশা জন্মাচ্ছে, আর সেই মশার কামড়েই আজ আমার ছেলে হাসপাতালে।”
ভোলার স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান এই সংকটের গভীরতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত জেলায় ৩০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বর্ষা নামতেই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়; জুন মাসের প্রথম ১৯ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন আরও ১৫ জন। অথচ গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালের পুরো জুন মাসে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন। এই তুলনামূলক চিত্রই বলে দেয়, পরিস্থিতি কতটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, শহরের প্রাণকেন্দ্রের কিছু এলাকায় মাঝেমধ্যে ড্রেন পরিষ্কার বা মশা মারার ওষুধ ছিটানো হলেও যুগিরঘোল, চরজংলা, উকিলপাড়া, মুসলিম পাড়া, জামিরালতা ও সাগর বেকারি এলাকার মতো প্রান্তিক ওয়ার্ডগুলো পুরোপুরি উপেক্ষিত। এসব এলাকার বাসিন্দারা বছরজুড়েই মশার উপদ্রবে ভুগে থাকেন, যা বর্ষায় অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।
জামিরালতা এলাকার বাসিন্দা মো. আল আমিন ও মো. মাকসুদ জানান, “সন্ধ্যার পর মশার কামড়ে রাস্তায় দাঁড়ানো তো দূরের কথা, ঘরেও টেকা দায়। গত ছয় মাসে আমাদের এলাকায় ড্রেন পরিষ্কার করতে বা মশার ওষুধ ছিটাতে দেখিনি।” একই অভিযোগ যুগিরঘোল এলাকার মো. লিটন ও মুরাদের। তাঁরা জানান, স্থানীয় ঈদগাহ জামে মসজিদের পুকুরটি দীর্ঘদিন ধরে আবর্জনায় ভরা থাকায় সেটি মশার কারখানায় পরিণত হয়েছে, কিন্তু পরিষ্কারের কোনো উদ্যোগ নেই।
দেশের অন্যতম প্রথম শ্রেণির এই পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডে কয়েক লাখ মানুষের বাস। জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত বছরগুলোতে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো এখন মশার আঁতুড়ঘর। পৌরসভার পাঁচটি প্রধান খাল—আন্ধির খাল, আলীনগর খাল, চরজংলা খাল, বালিয়াকান্দি খাল ও ভোলার খাল—এবং শতাধিক পুকুর পরিষ্কার না করায় পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে মশার বংশবিস্তারের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. ফজলু ও শাহে আলম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “আমরা নিয়মিত পৌরকর পরিশোধ করি, কিন্তু বিনিময়ে ন্যূনতম নাগরিক সেবাটুকুও পাই না। মশার অত্যাচারে সন্ধ্যার পর ঘরে থাকাই কষ্টকর।”
এই বিশাল এলাকার জন্য পৌরসভার রয়েছে মাত্র চারটি ফগার মেশিন, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। ফলে মশক নিধন কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম আজাদ কিছু সরু ড্রেন পরিষ্কার না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, “শিগগিরই এগুলো পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে মশক নিধন শতভাগ সফল হয়।” তিনি আরও জানান, ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর পরিষ্কারের দায়িত্ব পৌরসভার না হলেও মালিকদের চিঠি দিয়ে সচেতন করা হবে এবং প্রয়োজনে পৌরসভা সহযোগিতা করবে।
অন্যদিকে, ভোলার সিভিল সার্জন ডা. মু. মনিরুল ইসলাম ডেঙ্গু মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, “সকলকে নিজ নিজ আঙিনা পরিষ্কার রাখতে হবে এবং কোথাও তিন দিনের বেশি পানি জমতে দেওয়া যাবে না। ভোলায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এমন পরিস্থিতিতে ভোলায় এখনই সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বর্ষার তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে জরুরি ভিত্তিতে ড্রেন ও খাল পরিষ্কার, পর্যাপ্ত ফগার মেশিন দিয়ে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো এবং জোরালো জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা এখন সময়ের দাবি। পৌরসভার উদাসীনতা কাটিয়ে না উঠলে এই জনস্বাস্থ্য সংকট থেকে মুক্তি মেলা কঠিন হবে বলে মনে করছেন ভোলার বাসিন্দারা।