বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক নেতিবাচক প্রবণতা দেখাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ইরান-ইসরাইলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। বিশেষ করে, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে জ্বালানি, শ্রমবাজার এবং আমদানি সরবরাহ শৃঙ্খলে মারাত্মক প্রভাব পড়বে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করতে পারে।
যুদ্ধের প্রভাব: তিনটি প্রধান খাত
১. জ্বালানি খাতে সংকট
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ, যিনি বার্ষিক ৬০-৭০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করে, এই দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ও পরিবহন খরচে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়বে। বিশেষ করে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে, যা বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জ্বালানি পরিবহনের প্রধান রুট। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরি বলেন, “জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প, কৃষি এবং পরিবহন খাতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।”
২. শ্রমবাজার ও রেমিট্যান্স
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক কর্মরত, যারা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস রেমিট্যান্সের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে, যা রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের ধাক্কা সৃষ্টি করবে।” গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা এই প্রবাহকে ব্যাহত করতে পারে।
৩. আমদানি ও রপ্তানি সরবরাহ শৃঙ্খল
হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বাংলাদেশের আমদানি পণ্য, বিশেষ করে জ্বালানি তেল, খাদ্য এবং সার, যা মোট আমদানির ৩০ শতাংশ, সরবরাহে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটবে। এছাড়া, সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর রুট ব্যবহারে ঝুঁকি বাড়লে জাহাজগুলোকে আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ দিয়ে যেতে হবে, যা শিপিং খরচ ৩০-৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে এবং চালানে ১০-১৫ দিন বিলম্ব ঘটাবে। বিজিএমইএর সদ্য নির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “এই পরিস্থিতি তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাকে ব্যাহত করবে এবং ক্রয়াদেশ বাতিলের ঝুঁকি তৈরি করবে।”
বিশ্ববাজারে অস্থিরতা
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতেও বড় ধরনের ধাক্কা সৃষ্টি করছে। ইতোমধ্যে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার ছুঁয়েছে, যা শিগগিরই ১৩০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তুলে নিয়ে সরকারি বন্ড ও সোনার মতো নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছেন। পশ্চিমা দেশগুলো মূল্যস্ফীতির নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা করছে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও সংকটজনক।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “ইরান ও ইসরাইলের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি অর্থনৈতিক সম্পর্ক সীমিত হলেও, যুদ্ধের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও ওমানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এই অঞ্চলে অস্থিরতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা চাহিদা কমবে, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।”
সমাধানের পথ
বিশ্লেষকরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রতি বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন:
বিকল্প জ্বালানি উৎস: জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি: এলএনজি সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি নিশ্চিত করা।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কৌশলগত ব্যবস্থাপনা।
খাতভিত্তিক প্রণোদনা: তৈরি পোশাক ও অন্যান্য রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ধরে রাখতে প্রণোদনা প্রদান।