প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন উচ্চ শুল্ক নীতি সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল এবং ভারতের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে, যা বাণিজ্য উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ও প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। এই শুল্কগুলো ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে, যা বিশ্ব বাণিজ্যের কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী, ব্রাজিলের পণ্যের উপর ৫০% শুল্ক, সুইজারল্যান্ডের উপর ৩৯%, এবং ভারতের উপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া, ভারতের রাশিয়া থেকে তেল ক্রয়ের কারণে ২১ দিনের মধ্যে অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই শুল্কগুলোর লক্ষ্য মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করা, তবে এটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়েছে।
ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী ফার্নান্দো হাদ্দাদ জানিয়েছেন, সরকার শুল্কের প্রভাব কমাতে কোম্পানিগুলোর জন্য একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে। ব্রাজিলের রপ্তানির প্রায় ২% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায়, এবং ৫০% শুল্ক দেশটির অর্থনীতির উপর ০.৬% থেকে ১% জিডিপি হ্রাসের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে জে.পি. মরগানের অর্থনীতিবিদ ভিনিসিয়াস মোরেইরা পূর্বাভাস দিয়েছেন। ট্রাম্প ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর বিচারের সমালোচনা করে এই শুল্ককে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন। তবে, বিমান, শক্তি, এবং কমলার রসের মতো কিছু পণ্য এই শুল্ক থেকে ছাড় পেয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট কারিন কেলার-সাটার ট্রাম্পের সাথে ফোনে আলোচনা করেছেন, তবে শুল্ক বৃদ্ধি এড়াতে কোনো চুক্তি হয়নি। দেশটি ৩৯% শুল্কের বিরুদ্ধে একটি “আলোচিত সমাধান” খুঁজছে। সুইস ফ্রাঙ্ক মার্কিন ডলারের বিপরীতে ০.৫% পতন দেখেছে, যা বাজারে অস্থিরতার ইঙ্গিত দেয়। সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি, বিশেষ করে ঘড়ি এবং যন্ত্রপাতি রপ্তানি, এই শুল্কের কারণে চাপের মুখে পড়তে পারে।
ভারতের পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক এবং রাশিয়ান তেল ক্রয়ের জন্য অতিরিক্ত ২৫% শুল্কের হুমকি দেশটির কৃষি ও দুগ্ধ খাতকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ভারত ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে আলোচনায় বেশ কিছু ছাড় দিয়েছিল, যার মধ্যে হার্লে-ডেভিডসন মোটরসাইকেলের উপর শুল্ক হ্রাস অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে, ভারতের কৃষি খাতে প্রবেশাধিকার নিয়ে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ভারতীয় রুপি মূল্য হ্রাস পেয়েছে, এবং বিরোধী দল এই শুল্কের তীব্র সমালোচনা করেছে। এক্স-এ পোস্ট অনুযায়ী, ভারত মার্কিন পণ্য আমদানি বাড়িয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করছে, তবুও এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ল্যাবের হিসাব অনুযায়ী, এই শুল্কগুলো মার্কিন গ্রাহকদের জন্য পোশাকের দাম ৩৮% এবং জুতার দাম ৪০% বাড়াতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে, পোশাকের দাম ১৭% এবং জুতার দাম ১৯% বেশি থাকতে পারে। মার্কিন পরিবারগুলোর উপর গড়ে ২,৪০০ ডলারের অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) ২০২৫ সালের জন্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে, যা শুল্কের কারণে মার্কিন অর্থনীতির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশগুলো ইতিমধ্যে প্রতিশোধমূলক শুল্ক ঘোষণা করেছে। কানাডা ২০.৬ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন আমদানির উপর ২৫% শুল্ক আরোপ করেছে, যার মধ্যে ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়াম পণ্য অন্তর্ভুক্ত। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মিত্র দেশগুলো ১৫-২০% শুল্কের মাধ্যমে চুক্তিতে পৌঁছেছে, তবে ব্রাজিল এবং ভারতের মতো দেশগুলোর সাথে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে এই শুল্ক যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী মন্দার ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন যে এই শুল্কগুলো মার্কিন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আনবে। তিনি তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে বলেছেন, “শুল্কের মাধ্যমে বিলিয়ন ডলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাহিত হবে, যা এমন দেশগুলো থেকে আসবে যারা বহু বছর ধরে আমাদের সুবিধা নিয়েছে।” তবে, অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন যে এই শুল্কের বোঝা মূলত মার্কিন গ্রাহক এবং ব্যবসায়ীদের উপর পড়বে, যা দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহ চেইন ব্যাঘাতের কারণ হতে পারে।
ট্রাম্পের শুল্কগুলো আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন (IEEPA)-এর অধীনে আরোপ করা হয়েছে, যা মে ২০২৫-এ মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত অবৈধ বলে রায় দিয়েছিল। তবে, আপিলের সময় এই শুল্কগুলো কার্যকর রয়েছে। আগামী ৩১ জুলাই ফেডারেল আপিল আদালতে এই মামলার শুনানি হবে, যা শুল্ক নীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে।