চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং শনিবার (২৬ জুলাই, ২০২৫) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য একটি বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। বেইজিং-এ ডিজিটাল ইকোনমি ফোরামে দেওয়া ভাষণে তিনি এআই-এর দ্রুত অগ্রগতি এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাবের উপর জোর দিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
লি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করেছেন, যা এআই প্রযুক্তির উন্নয়ন, নিরাপত্তা, এবং নৈতিক ব্যবহার নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। তিনি বলেন, “এআই-এর দ্রুত বিকাশ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি এবং সমাজের জন্য অভূতপূর্ব সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। একটি সমন্বিত কাঠামো এই প্রযুক্তির নিরাপদ ও দায়িত্বশীল বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে।”
লি উল্লেখ করেন, এআই ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জিডিপিতে ১৫.৭ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করতে পারে, যার মধ্যে চীনের অংশ হতে পারে ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। তিনি এআই-কে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, উদ্ভাবন ত্বরান্বিতকরণ, এবং শিল্প রূপান্তরের একটি প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন।
তিনি এআই-এর ঝুঁকি, যেমন গোপনীয়তা লঙ্ঘন, অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত, এবং অপব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি একটি বৈশ্বিক নীতি কাঠামোর মাধ্যমে এই ঝুঁকিগুলো মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
চীন এআই গবেষণা ও উন্নয়নে বিশ্বনেতা হওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। ২০২৪ সালে, চীনের এআই শিল্পের মূল্য ২০০ বিলিয়ন ইউয়ান (২৮ বিলিয়ন ডলার) ছাড়িয়েছে, এবং সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতকে ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
এই প্রস্তাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের এআই ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা চীনকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
লি-এর প্রস্তাব আসিয়ান দেশগুলো এবং গ্লোবাল সাউথের সাথে চীনের সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টার অংশ। তিনি উল্লেখ করেন, এআই সহযোগিতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রযুক্তিগত বৈষম্য কমাতে পারে।
আসিয়ানের কিছু সদস্য রাষ্ট্র, যেমন মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর, প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়েছে, কারণ তারা এআই উন্নয়নে চীনের সাথে সহযোগিতা থেকে উপকৃত হতে পারে।
পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এই প্রস্তাবের প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করছে। তারা উদ্বিগ্ন যে চীন এই সংস্থার মাধ্যমে এআই-এর বৈশ্বিক নীতি ও মান নির্ধারণে নেতৃত্ব দিতে চায়। এক্স-এ পোস্টগুলোতে কিছু ব্যবহারকারী এই প্রস্তাবকে চীনের “প্রযুক্তিগত আধিপত্য” প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
লি জাতিসংঘের এআই নিয়ে সাম্প্রতিক রেজোলিউশনের কথা উল্লেখ করেন, যা চীনের নেতৃত্বে গৃহীত হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত সংস্থাটি এই রেজোলিউশনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, যা এআই-এর নৈতিক ব্যবহার এবং সক্ষমতা বিনিময়ের উপর জোর দেয়।
চীনের এআই কোম্পানিগুলো, যেমন বাইদু, টেনসেন্ট, এবং হুয়াওয়ে, গভীর শিক্ষণ, প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ, এবং কম্পিউটার ভিশনের মতো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
চীন এআই নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি প্রয়োগ করছে, যার মধ্যে রয়েছে জেনারেটিভ এআই-এর জন্য কন্টেন্ট মডারেশন এবং ডেটা সুরক্ষা নিয়ম। এই প্রস্তাবটি বিশ্বব্যাপী এই ধরনের নিয়ন্ত্রণের মান প্রচারের লক্ষ্য বহন করে।
চীন ইতোমধ্যে আসিয়ান এবং আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে এআই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর চুক্তি শুরু করেছে। প্রস্তাবিত সংস্থাটি এই উদ্যোগগুলোকে একটি আনুষ্ঠানিক কাঠামোর অধীনে একীভূত করতে পারে।
পশ্চিমা দেশগুলো চীনের এআই উদ্যোগের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে চীনের ডেটা গোপনীয়তা এবং নজরদারি প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ তাদের নিজস্ব এআই নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, যেমন ইইউ-এর এআই অ্যাক্ট, প্রচার করছে, যা চীনের প্রস্তাবের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
এক্স-এ কিছু ব্যবহারকারী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে চীনের নেতৃত্বাধীন সংস্থা গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর স্বার্থের পরিবর্তে চীনের নিজস্ব এজেন্ডাকে অগ্রাধিকার দিতে পারে।
লি কিয়াং সংস্থাটির গঠনের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করেননি, তবে তিনি আসিয়ান, জাতিসংঘ, এবং অন্যান্য বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এই সংস্থা এআই গবেষণা, ডেটা শেয়ারিং, এবং নৈতিক মান নির্ধারণে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা বাড়াতে পারে। তবে, এর সাফল্য নির্ভর করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, এবং অন্যান্য প্রধান খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ এবং বিশ্বাসের উপর।
এই প্রস্তাব চীনের প্রযুক্তিগত কূটনীতির অংশ, যা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং ডিজিটাল সিল্ক রোডের মতো উদ্যোগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং-এর বিশ্বব্যাপী এআই সহযোগিতা সংস্থার প্রস্তাব এআই-এর দ্রুত বিকাশের প্রেক্ষাপটে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এটি এআই-এর নিরাপদ ও নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে, তবে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং বিশ্বাসের ঘাটতি এর বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আগামী মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া এবং এই প্রস্তাবের বিস্তারিত কাঠামো এআই-এর বৈশ্বিক শাসনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে।